পেনশনের টাকায় অনেকে করেন বাড়ি-গাড়ি । কেউ আবার টাকা জমিয়ে রাখেন বিপদ-আপদের কথা চিন্তা করে। কেউ হয়তো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। কেউ আবার ব্যতিক্রমী কিছু করেন। এ ব্যতিক্রমী দলে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা মিয়া।
নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে গিয়ে বাড়ি তো করেননিই, উল্টো বাবার তৈরি দোতলা বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। বই-ই তাঁর কাছে বড় সম্পদ। সকালের শুভ্র আলোয় দিনটা শুরু করেন বইয়ের স্পর্শে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ও বুকের ওপর বই।
বইয়ের এ মানুষটি অন্যদের বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন দিনের পর দিন। যে কেউ তাঁর পাঠাগার থেকে বই নিয়ে পড়তে পারে। একেবারে বই দেওয়া না গেলে অন্তত ফটোকপি করে দেন তিনি। তা ছাড়া কারো কোনো বিশেষ তথ্যের প্রয়োজন হলে সেটা কোথায় কিভাবে পাওয়া যাবে তাতেও সহযোগিতা করেন। তাঁর এই পাঠাগার সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
৬৪ বছর বয়সী বইয়ের মানুষটি সবার কাছে পরিচিত ‘মোস্তফা স্যার’ হিসেবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রখ্যাত নরসিংদী জেলার সর্বত্র যেখানে বৈষয়িক বিষয় নিয়ে সবাই ব্যস্ত; সেখানে মোস্তফা স্যার জ্বালিয়ে রেখেছেন জ্ঞানের প্রদীপস্বরূপ ব্যক্তিগত পাঠাগার।
নরসিংদী শহরের ১৪৪ নম্বর পশ্চিম ব্রাহ্মণদী ঠিকানা হলেও ‘মোস্তফা স্যার’র বাসা খুঁজতে কোনো নম্বর লাগে না। কাউকে তাঁর নাম বললেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেই ঠিকানায়।
ব্রাহ্মণদীতে মোস্তফা স্যারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িটির দোতলা নানা বই, পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, জার্নাল ও স্মরণিকায় ঠাসা। দুষ্প্রাপ্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, জার্নাল, স্মরণিকা ও লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যাই কয়েক হাজার হবে। তিনি নিজেও শতবর্ষী সাটিরপাড়া কালী কুমার ইনস্টিটিউশন, নরসিংদী সরকারি কলেজ এবং দত্তপাড়া পাবলিক লাইব্রেরি প্রকাশিত স্মরণিকাসহ আরো অনেক স্মরণিকা ও জার্নাল সম্পাদনা করেছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে গোলাম মোস্তফার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে ব্যক্তিগত একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। শিক্ষকতা পেশায় যাওয়ার পর তিনি বেতনের টাকা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমিয়ে বই, পত্রিকা ও জার্নাল এবং স্মরণিকা কিনে বাসায় জমিয়ে রাখতে শুরু করেন। যেখানেই ভালো ও দুষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজ পেয়েছেন সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন। প্রয়োজনে টাকা ধার করে বই কিনে এনেছেন। অনেক সময় বেতনের টাকায় বই কিনে বাড়ি ফিরেছেন। অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকার একটি বড় অংশ তিনি এই পাঠাগারের পেছনে খরচ করেছেন।
বাবা গোলাম মোস্তফা সম্পর্কে তাঁর মেয়ে অনন্যা প্রতীতি বলেন, ‘আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা কি না তা আমি জানি না। তবে তিনি যে পৃথিবীর সেরা একজন মানুষ সে কথাটি বলতে পারি। বাবাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে তাঁর কিছু সঙ্গীর কথা বলতে হয়। আর সেসব সঙ্গী হলো তাঁর অতি প্রিয় বই। বাবার বন্ধু-বান্ধবদের সংখ্যা কম নয়। তবে সে তালিকার সর্বাগ্রে বইয়ের স্থান। ’
কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত তাঁর ‘দূর থেকে দেখা স্বপ্ন’ নিবন্ধেও গোলাম মোস্তফা সম্পর্কে লিখেছেন। তাতে বলা হয়, ‘অধ্যাপক প্রবন চক্রবর্ত্তীর (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছেন) মুখ থেকে শুনেছি অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সাহেবের বিশাল একটি লাইব্রেরি রয়েছে। আমি বুঝতে পারি মানুষটি কী এবং কেমন। বিস্ময় এই, লাইব্রেরির এই অরণ্য থেকে কোনো জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে আজও আগুন জ্বালিয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য উত্তাপ সৃষ্টি করছেন না? আমার বিশ্বাস অধ্যাপক সাহেব তৈরি হচ্ছেন গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের মতো স্বর্গ থেকে আগুনের মশালের দ্বারা উত্তাপ সৃষ্টি করে সমাজের হাতে তুলে দিতে। তাতেই তাঁর বই সংগ্রহের উদ্দেশ্য সভ্যতার কাজে লাগবে। ’
গোলাম মোস্তফার ৬৪তম জন্মবার্ষিকীতে মাধবদীর ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন গণপাঠাগারের উদ্যোগে গত বছরের ১০ নভেম্বর তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে গিরিশ চন্দ্র সেন গণপাঠাগারের সভাপতি মোহাম্মদ শাহীনুর মিয়া বলেন, ‘এমন মহান, নির্লোভ ও মননশীল মানুষ দেশে হাতে গোনা। বিদ্যা অর্জনের জন্য আজীবন বইয়ের জগতে বিচরণ করে গেছেন। ’
ব্যক্তিগত এই পাঠাগার সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা কালের কণ্ঠকে বলেন, বই পড়া বা সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশটা তিনি পারিবারিকভাবেই পেয়েছেন। বাবা ছিলেন শিক্ষা কর্মকর্তা। বাবার কাছ থেকে বই পড়া ছাড়াও ভালো কাজের অনুপ্রেরণা পেতেন কলেজ জীবনে। বাবা ভালো ভালো বই পড়তেন এবং তাঁকেও পড়তে দিতেন। তিনি বলেন, ‘ছাত্রাবস্থায় অনেকেই চুল আচড়ানোর জন্য ব্যাকব্রাশ কিনত। আমি চিন্তা করতাম ব্যাকব্রাশ কিনব না এ টাকা দিয়ে একটা বই কিনব। পরে আমার মন বই কেনার পক্ষেই সায় দিত। ’
গোলাম মোস্তফা আরো বলেন, ‘আমি নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়াশোনা শেষ করে সেই কলেজেরই অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যাই। এ শহরে অনেক গুণী মানুষের জন্ম। কবি হরিচরণ আচার্য, শিক্ষাবিদ ও জমিদার ললিতমোহন রায়, রাজনীতিবিদ সুন্দর আলী গান্ধী প্রমুখের কাছ থেকে আমি সংস্কৃতিচর্চা এবং সমাজসেবার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বই পড়া, বই সংগ্রহ, দুষ্প্রাপ্য বই, পত্রিকা, সাহিত্য ইত্যাদি সংগ্রহ করার কাজটা আমৃত্যু ধরে রাখতে চাই। ’
সূত্র: কালের কণ্ঠ।