জনপ্রিয় প্রমোদনগরী৷ ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ থেকে বিলাসবহুল হোটেল, ক্যাসিনো। রাত এখানে দিনের মতোই উজ্জ্বল।
সারা বছরই এই লাস ভেগাসে ভিড় জমান বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ। তাই হোটেলগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও চোখে পড়ার মতো। সেই বর্জ্রআঁটুনির ফাঁক গলেই ‘ম্যান্ডালে বে’ রিসোর্টের ৩২ তলায় নিজের ঘরে রীতি মতো অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছিল স্টিফেন প্যাডক। হামলার পর যেখানে তল্লাশি চালিয়ে ২৩টি নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ, যার মধ্যে একটি হ্যান্ডগান এবং কয়েকটি রাইফেলও রয়েছে।
সব মিলিয়ে প্যাডকের প্রায় ৪০টি বন্দুক ছিল বলে অনুমান তদন্তকারীদের। হোটেলের পার্কিং লটে হামলাকারীর যে গাড়িটি রাখা ছিল, তার ভিতর থেকে মিলেছে ‘অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ’, যা দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরি করা যায়। গোয়েন্দাদের অনেকেই মনে করছেন, এই নারকীয় হত্যালীলার পর হয়তো আরও বড় কিছু ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল প্যাডকের। কিন্তু, পুলিশ তার নাগাল পেয়ে যাওয়ায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, যদিও ততক্ষণে সেখান থেকে ৫০০ মিটার দূরে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে একটা গোটা মাঠ। প্রাণ চলে গিয়েছে ৫৯ জনের।
গুলি বিঁধেছে আরও ৫২৭ জনের শরীরে!
প্রথমে মনে করা হচ্ছিল পুলিশ হোটেলের ঘরে পৌঁছনোর আগেই আত্মহত্যা করেছে হামলাকারী, কিন্তু, মঙ্গলবার লাস ভেগাসের শেরিফ জানিয়েছেন, হামলার পর ‘ম্যান্ডালে বে ’ রিসর্টের প্রতিটি ঘরে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা প্যাডকের ঘরে গিয়ে পৌঁছায়। বাঁচার জন্য পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিও চালিয়েছিল সে, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে যায়, পালানোর পথ নেই। এর পরই আত্মহত্যা করে সে।
‘ম্যান্ডালে বে ’র মতো প্রথম সারির একটি রিসোর্টে কীভাবে অস্ত্রঘাঁটি গড়ে তুলল হামলাকারী, তা ভাবাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের সবাইকে। এই ঘটনা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে তথাকথিত নিরাপদ ঠিকানাগুলির নিরাপত্তাকেও।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি যেখানে একসুরে দাবি করছে, এর আগে কোনও অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে প্যাডকের নাম জড়ায়নি, সেখানে তার বাড়িতে হানা দিয়ে যা উদ্ধার হয়েছে, তাতে আরও বেশ কয়েকটি এমন হামলা চালিয়ে দেওয়া যায়! কী ছিল না সেখানে! ১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল সংখ্যক কার্তুজ, বিস্ফোরক এবং বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম। এমন কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও মিলেছে যা টাইম বোমা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বলে তদন্তকারীদের অনুমান। কেন এই অস্ত্র ভাণ্ডার তৈরি করেছিল সে, এখনও সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় এফবিআই। কেনই বা লাস ভেগাসের সঙ্গীতানুষ্ঠানে এ ভাবে এত মানুষকে খুন করল সে, তাও জানে না কেউ। ইসলামিক স্টেট প্যাডককে নিজেদের ‘লোন উল্ফ’ বা ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ বলে দাবি করলেও, এখনও সেই দাবিতে সিলমোহর দেয়নি পুলিশ। তবে, একটি বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত, এই ষড়যন্ত্রে প্যাডকের সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। এটা তার একার কাজ।
আমেরিকার ইতিহাসে এমন হামলা নতুন নয়, কিন্তু, যে ঘটনা এটিকে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে তা হল সম্পূর্ণ ‘স্বয়ংক্রিয় ’ রাইফেলের ব্যবহার। এর আগে যতগুলি হামলা হয়েছে, তার কয়েকটিতে ‘সেমি -অটোমেটিক’ রাইফেল ব্যবহার হলেও, ‘ফুল -অটোমেটিক ’ এই প্রথম। তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তির কথায়, যে বন্দুক থেকে প্যাডক গুলি চালিয়েছে তা অনেকটা একে-৪৭ এর মতো। খুব কম সময়ে অনেক মানুষ খুন করা যায় এই ধরনের রাইফেল দিয়ে। এক বার ট্রিগার টিপলেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি! আমেরিকায় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় রাইফেল বাড়িতে রাখা বেআইনি। গোয়েন্দাদের অনুমান, ‘সেমি -অটোমেটিক’ রাইফেল কিনে তাতে কিছু অদল-বদল করে এই রাইফেল তৈরি করেছিল হামলাকারী। এই কাজ করা মার্কিন মুলুকে খুব একটা কঠিনও নয়, খরচসাপেক্ষও নয়।
লাস ভেগাসের আততায়ী স্টিফেন প্যাডকের বাবাও ছিল এফবিআই-এর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’-এর তালিকায়। একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় বিশ বছর জেলের ঘানিও টানতে হয়েছে স্টিফেনের বাবা বেঞ্জামিন প্যাডককে।
এফবিআই সূত্রে দাবি, লাস ভেগাসের বন্দুকহামলাকারীর বাবা বেঞ্জামিন প্যাডক ১৯৬১ সালের একটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ২০ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। এফবিআই-এর মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকাতেও তার নাম ছিল। বেঞ্জামিন প্যাডককে ‘সাইকোপ্যাথ’ হিসেবে উল্লেখ করে মার্কিন গোয়েন্দারা জানান, তার মধ্যে ‘আত্মহত্যার প্রবণতা’ও ছিল প্রবল। জেলে থাকাকালীন কয়েক বার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।