একদিকে সীমাহীন সাগর; আরেকদিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট টেংরাগিড়ি। একদিকে দীর্ঘ ঝাউবন, তিন তিনটি নদীর বিশাল জলমোহনা; আরেকদিকে সীমাহীন সাগর। সবমিলিয়ে নদ-নদী আর বন-বনানীর এক অপরূপ সমাহার- শুভ সন্ধ্যা সৈকত!
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝাউবন। দখিণের খোলা বাতাস ঝাউবন স্পর্শ করে যাচ্ছে পরম আবেশে। খোলা বাতাসের ছোঁয়ায় উড়ন্ত চুলের মতো দুলছে ঝাউগাছগুলো। জন্ম থেকেই সমুদ্রের খোলা বাতাস গায়ে মেখে ঝাউগাছগুলো এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ আর ঝাউগাছের মাঝখানে শূন্য বালুরাশি। দৃষ্টিনন্দন এক সৈকত! সমুদ্রের মৃদু ঢেউ, বালুময় দীর্ঘ সৈকত আর ঝাউবনের সবুজ সমীরণের এ দৃশ্যটি প্রকৃতি প্রেমের একটি উদাহরণ। এ প্রেমময় দৃশ্যপটের নাম- শুভ সন্ধ্যা।
বরগুনার প্রধান তিনটি নদী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় নবগঠিত তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের স্নিগ্ধ বেলাভূমিতে জেগে ওঠা চরের নাম রাখা হয়েছে “শুভসন্ধ্যা”।
প্রকৃতির সাথে সময় কাটিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের পানে তাকিয়ে জোছনা উৎসব পালিত হলো। হেমন্তের শিশিরে নগ্ন পায়ে হাঁটার স্মৃতি অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন! মোম-জোছনায় চোখ-মন ভরানো হয় না কতকাল তা আপনার চেয়ে ভালো আর কে জানে! তাইতো এ আয়োজন, “জোছনা উৎসব”। ত্রিমোহনার রূপালি জলরাশি ঘেঁষে বিস্তীর্ণ সৈকতে বসে হৈমন্তী পূর্ণিমা দেখে আপনি শিহরিত হবেনই। জোছনাপাগল হাজারো মানুষের সাথে গান, কবিতা, পুঁথি, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শণী, যাত্রাপালা, হয়লা গান, নৃত্য, ফানুস ওড়ানো দেখে আপনাকে মুগ্ধ হতেই হবে। ১২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার পূর্ণিমায় এখানেই জলজোছনায় একাকার হয় জোছনাবিলাসী হাজারো মানুষ।
অভিজ্ঞতা আর স্মৃতিকে সমৃদ্ধ করতে মুজিববর্ষ উপলক্ষে তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের স্নিগ্ধ বেলাভূমি শুভ সন্ধ্যার বিস্তীর্ণ বালুচরে পঞ্চমবারের মত এ উৎসবের আয়োজন করে বরগুনা জেলা প্রশাসন।
পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনাময় বরগুনার নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে এ উৎসবে যোগ করা হয় নানা আয়োজন।
উৎসবকে ঘিরে ইতোমধ্যেই শুভ সন্ধ্যা সৈকতে শুরু হয়েছে বাহারি পণ্যের পসরা সাজানোর প্রস্তুতি। শুভ সন্ধ্যায় দেখা যাবে, সাগরপাড়ে সবুজের সমারোহে বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও পাখির কুহুতান। মৃদু ঢেউয়ের ভালোবাসা পায়ে লাগিয়ে, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে গোধূলি সন্ধ্যায় দেখা যাবে সূর্যাস্ত। দখিণে তাকালে অথৈ সাগরের ঢেউ আর ঢেউয়ের সাথে দোল খেলা মাছ ধরার ট্রলার ব্যতীত আর কিছুই দেখা যাবে না।
শুভ সন্ধ্যার পাশেই আশার চরের অবস্থান। অসংখ্য মৎস্যজীবীর বসবাস এ চরে। আবার শীতের মৌসুমে পর্যটকরাও সেখানে যান। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, গভীর অরণ্য, বিশাল শুঁটকিপল্লী রয়েছে আশার চরে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যাওয়া মানুষ শুঁটকি উৎপাদনের জন্য চরটিতে ঘর বাঁধে। বছরে সাত থেকে আট মাস থাকে শুঁটকি উৎপাদনের ব্যস্ততা। আশার চরের কাছেই রয়েছে তালতলীর বিশাল রাখাইন পল্লী। বঙ্গোপসাগরের তীরে এ পল্লীতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাঁতে কাপড় বোনার কাজ। তাঁতশিল্প ছাড়াও রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ মন্দিরও অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ হতে পারে। আশারচরের শুঁটকি পল্লী, টেংরাগিড়ি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সোনাকাটা ইকোপার্কের হরিণসহ বন্যপ্রাণী ইত্যাদি দেখার পাশাপাশি দেখা মেলে মৎসজীবীদের কর্মব্যস্ততা আর সৈকতের বুকে স্থানীয় শিশুদের উচ্ছ্বাস। এখানে নদী সমুদ্রের তাজা মাছ পাওয়া যায় ফকিরহাট বাজারের ছোট ছোট খাবারের হোটেলগুলোতে, যা পর্যটকদের পেট ভরায়। এখানে খুব অল্প টাকায় খাওয়া যাবে মাছ ভাত বা গ্রামীণ স্থানীয় সব খাবার। এ সৈকতটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে নবীন বিবেচনায় খাবার ও মাছের দাম তুলনামূলক সস্তা।