সাগর গর্ভে, নিঃসীম নভে, দিগদিগন্তে জুড়ে
জীবনাদ্বেগে তাড়া করে নিতে যারা মৃত্যুরে,
মানিক আহরি ‘অনেক যারা খুড়ি’ পাতাল যক্ষপুরী;
নাগিনীর বিষ-জ্বালা সয়ে করে ফনা হতে মনি চুরি।
হানিয়া বজ্র-পানির বজ্র উদ্ধত শিরে ধরি’
যাহারা চপলা মেঘ কন্যারে করিয়াছে কিঞ্চরী।
পবন যাদের ব্যঞ্জনী দুলায় হইয়া আজ্ঞাবাহী,-
এসেছি তাদের জানাতে প্রণাম, তাহাদের গান গাহি।
ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং যে সমাজ-সংগঠন তা থেকে আবশ্যিকভাবে গড়ে উঠে, তাই থাকে সেই যুগের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের মূলে। সুতরাং জমির আদিম যৌথ মালিকানার অবসানের পর থেকে সমগ্র ইতিহাস তাই হয়ে এসেছে শ্রেনী সংগ্রামের ইতিহাস।
বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েতদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব তথা শ্রেনীসংগ্রামের পথ ধরে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বির্নিমানে রক্ত ও ঘামঝড়ানো শ্রমিকদের প্রতিই প্রণতি জানিয়েছেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
অ্যাডম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো অর্থশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব ভূমিকা রেখেছিলেন। তারা দেখিয়েছিলেন শ্রমের মূল্যতত্ত্ব। অন্যদিকে কার্ল মার্ক্স দেখান, শ্রমের মূল্যতত্ত্ব এবং শ্রমশক্তির মূল্যের ফারাকই হল উদ্ধৃত্তমূল্য। উদ্বৃত্তমূল্যের সৃষ্টি এবং আত্মসাৎই হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উদ্ভব ও শ্রমিক শোষণের প্রধান কারণ।
১৮৮৬ সালের ১লা মে শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কর্মঘন্টার দাবিতে আমেরিকার সব শিল্প এলাকায় ধর্মঘটের ডাক দেয়। শিকাগো শহরের ৩ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখে এবং প্রায় ১ লক্ষ ৮৫ হাজার শ্রমিক সমবেত হয় ঐ শহরের হে মার্কেটে। বিক্ষোভের এক পযায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান ১০ শ্রমিক।
নিমিষেই সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। মার্কিন সরকার মেনে নেয় ৮ ঘন্টা কর্মঘন্টার দাবি। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১লা মে শিকাগোর শ্রমিকদের রক্তদানকে। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হতে থাকে ‘মে দিবস’।
বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে প্রথম মে দিবস পালন শুরু হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসনকালে শোষনের বিরুদ্ধে এ দিবস পালন ছিল বেশ তাৎপর্যমণ্ডিত। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ‘মে দিবসকে’ সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষনা করেন।
শ্রমিক অধিকারকে সংরক্ষণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধন-২০১৩) প্রণয়ণ করেছে। এ আইনের ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোন শিশু ও কিশোরকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। ৩৯ ধারা অনুযায়ী, সরকার সময় সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষনা করবে, এবং উক্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোন কিশোরকে নিয়োগ করা যাবে না।
এ আইনের ৪৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোন প্রতিবন্ধী শ্রমিককে বিপদজনক যন্ত্রপাতির কাজে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। ৯৪ ধারা অনুযায়ী, সাধারনত: চল্লিশ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত আছেন, এরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে তাদের ৬ বছরের কম বয়সী শিশু সন্তানদের ব্যবহারের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ঐ কক্ষে যথেষ্ট স্থান সংস্থান, আলো ও বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকবে এবং তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রক্ষনাবেক্ষন করতে হবে এবং কক্ষটি শিশুদের পরিচর্যার জন্য অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলার তত্ত্বাবধানে থাকবে।
এ আইনে ৯৯ ধারায় শ্রমিকদের গ্রুপ বীমা চালু করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৪০ (ক) ধারা অনুযায়ী, শ্রমিকের জন্য নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করবে সরকার।এছাড়া একই আইনের ১৬০ ধারায় শ্রমিকদের জন্য দুর্ঘটনাজনিত বীমাস্কীম চালু করার কথা বলা হয়েছে।
শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার পৃথক শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বৎসরে শিশু শ্রম সম্পর্কিত ৫৯টি মামলা শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আশুলিয়া, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ, লালবাগ প্রভৃতি বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এসব মামলা করে পুলিশ।
শ্রমিক বঞ্চনা ও শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে যৌক্তিক মজুরি, শ্রমঘন্টা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে সরকারের পাশাপাশি সমাজের সব শ্রেনীপেশার মানুষকে পালন করতে হবে সক্রিয় ও ইতিবাচক ভূমিকা। তবেই দেশের শিশুরা ভবিষ্যতে মানবসম্পদ তথা জাতির প্রকৃত কর্ণধার হয়ে উঠবে।
লেখক : সুব্রত দাস
সাব-ইন্সপেক্টর
মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস্ বিভাগ
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।