ডিএমপি নিউজ রিপোর্টঃ ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ । রাত বাড়ছে । আমি তখন রাজারবাগ ওয়ারলেস বেইজ স্টেশনের দায়িত্বে। কদিন ধরেই মনের মধ্যে কেবল অস্থিরতা। সময় খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। দেশের পরিস্থিতি যেকোন সময় খারাপ হয়ে যেতে পারে। মনের মধ্যে কেবল কু-ডাক ডাকছিল। মেসেজটা এল ঠিক তক্ষুনি। তেজগাঁও পেট্রোল থেকে রেডিও মেসেজ-‘Charlie-7 for base, about 37 trucks loaded with Pak army proceeding towards Dhaka city.’ বুঝলাম, চূড়ান্ত মুহুর্ত উপস্থিত। আর দেরি করলাম না। মেসেজ পাওয়ার সাথে সাথেই রেডিও রিসিভার হাতে নিয়েই সারাদেশে পৌঁছে দিলাম পাক বাহিনীর আক্রমণের খবর-‘Base, for all stations of East Pakistan Police, we are already attacked by the Pak army, try to save yourself over.’, ভাবলাম, যাক অন্তত রাজারবাগের বাইরের সব স্টেশনকে সতর্ক করে দিতে পেরেছি। কিছুটা হলেও প্রস্তুতি নিয়ে লড়তে পারবে সবাই।
এরই মধ্যে হানাদাররা আক্রমণ শুরু করে দিল। আগেই ঢাকা শহরের সব জায়গায় বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়েছিল। জেনারেটর চালু করতে গিয়েও পারলাম না। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসকে চারদিক থেকে ঘিরে মুহূর্মুহূ গুলি ছুঁড়তে লাগল তারা। জবাবে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরাও অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র-গুলি নিয়ে যার যার মত পজিশনে বসে পাল্টা গুলি ছুঁড়ে জবাব দিতে লাগল। আমাদের অস্ত্র বলতে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। আর শত্রুপক্ষের হাতে আছে মেশিনগান, ট্যাংক আর বোমা। ছুটে গেলাম চারতলার ছাদে। সেখান থেকেই আমাদের প্রতিরোধ চলতে থাকল পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে। চারদিক অন্ধকার, ঠিক মত ঠাহর করা যাচ্ছে না শত্রুপক্ষের অবস্থান। তবু আত্মরক্ষার তাগিদ আর পাকিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঝলসে উঠতে লাগল আমাদের রাইফেলের মাজল। দেখলাম রাজারবাগের কিছু কিছু জায়গায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আক্রমণকারীরা। আহত সহকর্মীদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠছিল আকাশ। সারারাত ধরে চলল অসম যুদ্ধ। ফজরের আযানের সময় পাঁচজন পাক আর্মি মারা পড়ল আমাদের হাতে। আমরা সংখ্যায় একশ জনের মতো। কিন্তু জানি শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি। এভাবে আর পারা সম্ভব নয়। গুলিও শেষ হয়ে এল এক সময়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিরা আমাদের ঘিরে ফেলল। তখন ২৬ মার্চ ভোর আনুমানিক ৫টা। পুবাকাশে সূর্য মাত্র রঙ ছড়াতে শুরু করেছে। আমি চোখ মুছলাম। এগিয়ে আসছে সম্মিলিত বুটের শব্দ। আরেকটি নতুন ভোর দেখব কিনা জানি না। তবে মরতে হলে এ বিশ্বাস বুকে নিয়ে মরব, একদিন স্বাধীনতার সূর্য উদিত হবেই এ বাংলায়। একদিন বাংলার মুক্ত আকাশে উড়বেই লাল সবুজের পতাকা। বুকে ভরে দম নিয়ে শেষ পরণতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি বুটের শব্দ…এবার আরো কাছাকাছি।
(২৮ মার্চ গুরুতর আহত অবস্থায় পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর জিম্মায় মোঃ শাহজাহান মিয়াকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং স্বাধীনতার পর সাব ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরী থেকে অবসর নেন।)
মূল লেখা : ‘মনে পড়ে ৭১’ শাহজাহান মিয়া, প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেতার চালক
অনুলিখন : সুমন কান্তি চৌধুরী