বিশ্ব ব্যাপী আলোরণ সৃষ্টিকারী পানামা পেপারস কেলেংকারি মামলায় এবারের মত স্বপদে টিকে গেলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার মতো পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। তবে নওয়াজ ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের যে অভিযোগ উঠেছে, তা আরো তদন্ত করতে একটি যৌথ তদন্তদল (জেআইটি) গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানজুড়ে টান টান উত্তেজনা ও বিশ্বজুড়ে আলোচনার মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই রায় দেন। আদালতের রায়ের পর স্বস্তি ফিরেছে নওয়াজের সমর্থকদের মধ্যে।
নওয়াজ শরিফের ক্ষমতায় থাকা না থাকা নির্ভর করছিল এই মামলার রায়ের ওপর। দেশটির গণমাধ্যমগুলো বলছিল, আদালত যদি নওয়াজ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগের ওপর রুল জারি করেন সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নওয়াজকে সরে দাঁড়াতে হতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক রুল জারির বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় নওয়াজকে ক্ষমতা হারাতে হলো না।
পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন বলছে, পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে ছিলেন আসিফ সায়্যিদ খোসা, গুলজার আহমেদ, এজাজ আফজাল খান, আজমত সায়্যিদ ও ইজাজুল আহসান। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি খোসা ও গুলজার নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন। বাকি তিন বিচারপতি যৌথ তদন্তদল গঠনের পক্ষে রায় দেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সাংবাদিকদের জানান, পাঁচজন বিচারপতির বেঞ্চে ৩-২-এ রায় বিভক্ত হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর চিঠিতে পানামা কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তের জন্য যে কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন, আদালতও সেই রায় দিয়েছেন। খাজা আসিফ আরো বলেন, ‘আমরা সব ধরনের তদন্তের জন্য প্রস্তুত আছি। আজ আদালতে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে বিরোধীদের দেওয়া তথ্য-প্রমাণ যথেষ্ট নয়। আমরা সফল হয়েছি। ’
গত বছর বিতর্কিত পানামা পেপারস ফাঁস হয়। পানামাভিত্তিক আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকার এক কোটির বেশি নথি ফাঁস হয়। এসব নথিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং থেকে শুরু করে বলিউড সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফসহ বিশ্বের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের নাম উঠে আসে। ধনী আর ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কিভাবে, কোন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, সেসব তথ্য পানামা পেপারসে বেরিয়ে এসেছে।
ফাঁস হওয়া নথিতে নওয়াজের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনজন মরিয়ম, হাসান ও হোসেনের নাম এসেছে। নওয়াজের সন্তানরা মোসাক ফনসেকার মাধ্যমে পরিচালিত বিভিন্ন অফশোর কম্পানির মালিকানার অংশীদার। এসব তথ্য ফাঁসের পর পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবিতে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে এবং নওয়াজের পদত্যাগ দাবি করে। তখন নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন) দাবি করে, পাকিস্তান ও উপসাগরীয় অঞ্চলে বৈধ পথে পারিবারিক ব্যবসা থেকেই এ সম্পদ অর্জিত হয়েছে।
কিন্তু সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই), জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের বিক্ষোভের মুখে গত বছরের শেষ দিকে বিষয়টি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে বাধ্য হন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টে দুর্নীতির মামলা শুরু হয়। এরপর থেকেই বলা হচ্ছিল, তদন্তে অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া গেলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ক্ষমতা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘিরে কয়েক দিন ধরেই পাকিস্তানে টান টান উত্তেজনা চলছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারেও। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ইসলামাবাদে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দেড় হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আগামী বছর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে আদালতের পক্ষ থেকে ইতিবাচক রায় আসায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে নওয়াজের দল ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ।