উদ্দাম নাচ শুরু হঠাৎ করেই। আর তার পর বাকিরাও যোগ দিলেন সেই নাচে। একের পর এক নাচতে শুরু করে দিলেন বাকিরাও। তার পর আস্তে আস্তে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। এ যেন নাচের মড়ক। তবে কোনও গল্প নয়। ইতিহাসেও ঘটেছিল এমনটাই।
১৫১৮ সাল। ৬০০ বছর আগে বর্তমান ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গে (যদিও সেই সময় এটি একটি স্বাধীন শহর ছিল রোম সাম্রাজ্যের) এই ‘ডান্স-প্লেগ’-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল অসংখ্য মানুষের। ইতিহাসের পাতার এই ঘটনা নিয়েই রয়েছে নানা রকম তত্ত্ব। ইতিহাসবিদরাও দিয়েছেন, ভিন্ন ভিন্ন মত।
জুলাই মাসের গরমে রাস্তায় একদিন ত্রোফিয়া বা ত্রোউফিয়া নামের এক জন মহিলা নাচতে শুরু করলেন। সুস্থ মানুষ নাচতে শুরু করার কিছুক্ষণ পরেই থেমে যাবার কথা। কিন্তু এই মহিলার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি নাচতে শুরু করলেন। সারা দিন পেরিয়ে গিয়েছিল তাঁর নাচ আর থামে না।কেউ কেউ বলেন, সপ্তাহখানেক পরে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে নাচছেন আরও অসংখ্য মানুষ। কোনও ভাবেই বন্ধ হচ্ছে না তাদের সেই দুর্দমনীয় নাচ। যদিও বর্তমান ফ্রান্সে এই বিষয়টিকে শুধু মাত্র ‘মিথ’ বলেই উল্লেখ করেন গবেষকরা।
শোনা গিয়েছে, নাচতে নাচতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেউ কেউ। বাকিরা ফের নাচতে শুরু করেন। শহরের শাসক গোষ্ঠীর ধারণা, এ ভাবে অবিরত বাধাহীনভাবে নাচতে দিলে নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে নাচের ঝোঁক থেমে যাবে। বন্ধ হবে এ উন্মাদ নৃত্য। শহরের টাউন হলে সে সব মানুষের নাচার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।
শহরের নামকরা গায়ক, বাদ্যযন্ত্রী, পেশাগত নাচের শিক্ষকদেরও আনা হলো নাচের তাল দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। শাসকদের নাচ বন্ধ করার এ পরিকল্পনার ফল হলো হিতে বিপরীত। এতে কমলো না কারও নাচের ঝোঁক। দু-এক দিনের মধ্যেই এই নাচিয়েদের মধ্য যারা দুর্বলচিত্তের মানুষ তাঁরা হার্ট ফেলিওর, সেরেব্রাল স্ট্রোক বা অবসাদের কারণে মারা যেতে থাকে। কথিত আছে কয়েক’শ জন মারা যান। যদিও সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মারা গিয়েছিলেন মাত্র ১২ জন।
কেউ বলেছিলেন টারান্টুলা মাকড়শার কামড়ে এরকম হয়। কেউ আবার এই তত্ত্ব খারিজ করে দিয়ে বলেন, আসলে গভীর জলে ঝাঁপ দিয়ে একের পর এক আত্মহত্যা করেছিলেন অনেকেই। তা নিয়েই পরবর্তীতে ‘মিথ’ তৈরি হয়েছে। একটি তত্ত্বে বলা হয়েছিল, অন্ধকার ঘরে শুধুমাত্র পাঁউরুটি ও জল খাইয়ে প্রত্যেককে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, ফের তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এই কারণেই বহু দিন বদ্ধ থাকার পর আলোয় বেরিয়ে আসতেই এ রকম ঘটনা ঘটেছিল।
১৫২৬ সালেই প্যারাসেলসাস নামে এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ত্রোফিয়া খুব সম্ভবত স্বামীর আদেশ অমান্য করে নিজের নাচের ইচ্ছা পূরণ করতেই চেয়েছিলেন। হয়তো যৌন হতাশাও এর কারণ। রসায়নবিদ প্যারাসেলসাস আরও বলেন, এটি কোরিওম্যানিয়া। ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর মূল কারণ হিসাবে অসুখী স্ত্রীদের কথাই উল্লেখ করেন তিনি। চেষ্টা করা হয়েছিল নানা রকম পদ্ধতিতে সারিয়ে তোলার, যেমন সারা গায়ে কাপড় বেঁধে শুইয়ে রাখা। তবে তা কাজ করেনি।
তবে এটিই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া প্রথম এবং একমাত্র নাচের মহামারী নয়। ১৫১৮ সালের পূর্বে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ১০ বার এ মহামারীর দেখা পাওয়া গিয়েছিল। ১৩৭৪ সালের দিকে এ মহামারী দেখা গিয়েছিল বর্তমান বেলজিয়াম অঞ্চলে, উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সে এবং লুক্সেমবার্গে।
জার্মানিতে এ ধরনের মহামারী দেখা গিয়েছিল, একে বলা হচ্ছিল সেন্ট জন’স ডান্স। আবার অন্য এক দল গবেষক বলেন, এটি আসলে সিডেনহ্যাম কোরিয়া নামে এক ধরনের রোগ। মূলত শিশুদের হয়। তবে কোনও ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদেরও। রোগীর হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অযথা কাঁপতে থাকে। মনে হয় তিনি নাচ করছেন। সম্ভবত কোন রোগাক্রান্ত শাকসবজি বা কোন মাদক দ্রব্য এই নাচিয়েরা খেয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায়ই তাদের এই উন্মাদ নাচের নেশা উঠেছিল।